টিকা প্রদান একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক বিস্ময়কর উদ্ভাবন যা সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এটি শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষায় নয়, বরং সামাজিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও বিশাল অবদান রাখে। টিকা গ্রহণের মাধ্যমে আমরা ব্যক্তিগতভাবে মারাত্মক সংক্রামক রোগ থেকে সুরক্ষিত হই এবং সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিরাও সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে রক্ষা পায়। এই প্রবন্ধে আমরা টিকা বা ভ্যাকসিন কিভাবে মানবদেহে কাজ করে, টিকা প্রদানের গুরুত্ব, সাধারণ মানুষের মধ্যে টিকাদান সম্পর্কে ভ্রান্তি , টিকার উপকারিতা এবং টিকা প্রদানের কার্যক্রমের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবো।
টিকা প্রদান কীভাবে কাজ করে
টিকা সাধারণত দুর্বল বা মৃত জীবাণু, বা তাদের একটি অংশ দিয়ে তৈরি হয়। যখন আমরা টিকা গ্রহণ করি, তখন এটি দেহের ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করে তোলে ও আমাদের শরীরে একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করে যা সেই জীবাণু দেহে পুনরায় প্রবেশ করলে দ্রুত তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। টিকা প্রদানের মূল উদ্দেশ্য হল দেহকে একটি রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রদান করা। এটি মূলত দুটি উপায়ে কাজ করে:
1. প্রতিরোধমূলক টিকা: যা মানুষকে একটি নির্দিষ্ট রোগের থেকে রক্ষা করে।
2. থেরাপিউটিক টিকা: যা কোনো রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
টিকা প্রদানের গুরুত্ব
1. সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ: টিকা প্রদানের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন সংক্রামক রোগের প্রতিরোধ করতে পারি, যেমন হাম, বসন্ত, পোলিও, মিয়াসমা, হাই ব্লাড প্রেশার ইত্যাদি। এই টিকা প্রদানের ফলে রোগের প্রতিরোধ করা যায় এবং এটি ব্যক্তিগত সুরক্ষা প্রদান করে সাথে সাথে সমাজের মধ্যে সামাজিক সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে।
2. জীবন রক্ষা: অনেক সংক্রামক রোগ মৃত্যুর কারণ হতে পারে। টিকা প্রদানের মাধ্যমে আমরা এই রোগগুলি থেকে জীবন রক্ষা করতে পারি। অর্থাৎ, টিকা প্রদান সংক্রামক রোগ থেকে জীবন রক্ষা করে, মারণ রোগ প্রতিরোধ করে, এবং জটিলতা ও উপসর্গ কমায়। এটি বৃদ্ধ ,শিশু, গর্ভবতী নারী এবং অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের সুরক্ষা দেয়, ফলে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
3. দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সুরক্ষা: টিকাদান বা ভ্যাকসিন গ্রহণ প্রাথমিকভাবে কিছুটা খরচ সাপেক্ষ হলেও এটি দীর্ঘমেয়াদে রোগ প্রতিরোধ করে এবং চিকিৎসার খরচ কমায়, যা স্বাস্থ্য খরচ কমিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। টিকা দিয়ে মিয়াসমা (measles), পোলিও, ডিপথেরিয়া, এবং হেপাটাইটিস বি এর মত রোগগুলো প্রতিরোধ করা যায়। এছাড়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং টিটেনাস নিয়মিত টিকা প্রদানের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়, যা রোগ পুনরায় হওয়ার ঝুঁকি কমায় এবং বারবার চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা দূর করে।
4. সামাজিক সুরক্ষা: যখন একটি সমাজে অধিকাংশ মানুষ টিকা গ্রহণ করে, তখন এটি "হার্ড ইমিউনিটি" গড়ে তোলে, যা সমাজের সকলকে রক্ষা করে। যখন একটি সমাজের অধিকাংশ মানুষ একটি নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে যায় এবং এতে করে রোগটির বিস্তারকে সীমিত হয় সেই অবস্থাকে হার্ড ইমিউনিটি বলে। কিছু মানুষ রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসা ব্যতীত প্রাকৃতিকভাবে রোগমুক্ত হয় আবার কিছু মানুষ টিকা গ্রহণের মাধ্যমে রোগাক্রান্ত হয়। তখন সে সকল মানুষ রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে উঠে। ফলে তাদের দেহ পুনরায় রোগাক্রান্ত হয় না।
ধরা যাক, একটি সমাজে ৯৫% মানুষ কোভিড-১৯ (COVID-19) টিকা গ্রহণ করেছে। যদি কোনো রোগাক্রান্ত ব্যক্তি সেখানে আসে, তাহলে তার থেকে রোগটি ছড়ানোর সম্ভাবনা কমে যায়, কারণ অধিকাংশ মানুষ রোগটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধী। ফলে, নবজাতক বা যারা টিকা নিতে পারেনি তারা নিরাপদে থাকে।
সাধারণ ভ্রান্তি ও টিকা সম্পর্কে তথ্য
টিকা সম্পর্কে কিছু সাধারণ ভ্রান্তি প্রচলিত রয়েছে, যেমন টিকা থেকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে বা এটি অকার্যকর হতে পারে। অথচ সমস্ত টিকা ব্যাপক গবেষণা এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার পর নিরাপদ প্রমাণিত হয়েছে। বাস্তবে, টিকা গ্রহণের মাধ্যমে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অত্যন্ত বিরল এবং ক্ষণস্থায়ী ঘটনা । অধিকাংশ টিকা-ই সুরক্ষিত এবং কার্যকর। এছাড়াও অনেকে মনে করেন টিকা অপ্রয়োজনীয়, কারণ তারা কখনও সেই রোগের সম্মুখীন হননি। কিন্তু এটি টিকার সফলতার ফল। টিকা ছাড়া সেই রোগগুলো আবারও ফিরে আসতে পারে এবং মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
টিকার উপকারিতা
টিকা গ্রহণের মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে অনেক মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা করতে পারি, যেমন পোলিও, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি ইত্যাদি। এটি সম্প্রদায়িক সুরক্ষা উপেক্ষা করে সমাজে রোগের প্রাদুর্ভাব কমায় এবং সেই সমাজের অন্যান্য সদস্যরাও সুরক্ষিত থাকে যারা টিকা নিতে পারে না, যেমন নবজাতক বা অ্যালার্জির কারণে টিকা নিতে পারেন না। এছাড়াও, টিকার মাধ্যমে সংক্রামক রোগের কারণে মৃত্যুর হার অনেকটাই কমেছে, যেমন পোলিও এর মহামারি দেশে অপ্রচলিত হয়ে গেছে টিকা কর্মসূচির জন্য। এছাড়াও, টিকা রোগ প্রতিরোধ করে, ফলে চিকিৎসার খরচ কমে যায় এবং স্বাস্থ্য সেবার প্রয়োজনীয়তা ও চাপ কমে।
টিকা প্রদানের কার্যক্রমের প্রভাব
বিশ্বজুড়ে টিকা প্রদানের কার্যক্রমের ফলে অনেক সংক্রামক রোগের প্রকোপ কমে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, পোলিও প্রায় নির্মূল হয়েছে এবং বসন্ত সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা হয়েছে। টিকা প্রদানের মাধ্যমে আমরা আরো অনেক রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। টিকা প্রদান আমাদের সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য নয়, সামগ্রিকভাবে সামাজিক স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশাল ভূমিকা পালন করে। সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে টিকার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই, আমাদের সকলের উচিত টিকা গ্রহণের বিষয়ে সচেতন হওয়া এবং এটি সম্পর্কে প্রচার করা। সঠিক তথ্য ও সচেতনতার মাধ্যমে আমরা টিকার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝতে পারি এবং অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করতে পারি। টিকা গ্রহণ করে আমরা একটি সুস্থ এবং নিরাপদ সমাজ গড়ে তুলতে পারি।
আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ! আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণে সাহায্য করবে।
লিখেছেন-
সিনহা আক্তার
কন্টেন্ট লিড
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইনোভেটিভ হেলথ রিসার্চ
Our Address
Mirpur, Dhaka-1216, Bangladesh
(Currently Online)
Our Activities
Research Internship Program
Basics of Research Methodology
Data Collection Tools
Data Analysis with SPSS