জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী সর্ববৃহৎ জটিল সমস্যা। শুধু প্রাকৃতিক পরিবেশ নয়, জলবায়ুর এই বিরূপ প্রভাব অত্যন্ত গভীরভাবে আমাদের মানব সমাজের উপর ও প্রভাব ফেলছে । পরিবেশের এই ক্রমাগত পরিবর্তন আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ও ক্ষতিকর । জলবায়ু পরিবর্তন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? কিভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে তা নিয়েই এ পর্যায়ে আলোচনা করা হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন হল পৃথিবীর আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন। এটি সাধারণত কয়েক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে ঘটে। জলবায়ু পরিবর্তন প্রাকৃতিক কারণে কিংবা মানুষের ক্রিয়াকলাপের ফলে হতে পারে। মানুষের কর্মকাণ্ড, যেমন জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো (তেল, কয়লা, গ্যাস), বন কাটা এবং শিল্প কারখানার দূষণ, বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
এই গ্যাসগুলি পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে তোলে, যা গ্লোবাল ওয়ার্মিং নামে পরিচিত। জলবায়ু পরিবর্তন এর ফলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, চরম আবহাওয়া এবং জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তাপপ্রবাহ, পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব, বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বিশেষ করে দরিদ্র এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ওপর বেশি প্রভাব ফেলছে।
জলবায়ু পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি আমাদের পৃথিবীর পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান এবং মানব জীবনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। যেমন:
1. প্রাকৃতিক দুর্যোগ: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা এবং তাপপ্রবাহের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
2. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি: গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে বরফ গলে যাচ্ছে এবং সমুদ্রের পানি উত্তপ্ত হচ্ছে, যার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এতে করে উপকূলীয় এলাকাগুলো হুমকির মুখে পড়েছে।
3. জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি: অনেক প্রজাতি তাদের আবাসস্থল হারাচ্ছে এবং বিপন্ন হয়ে পড়ছে। উদাহরণস্বরূপ মেরু ভালুক এর কথা বলা যায় । আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলে যাওয়ার কারণে তাদের বাসস্থান সংকুচিত হচ্ছে, এবং তারা শিকার খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়ছে। এছাড়াও পেঙ্গুইন,কোরাল রিফ, সামুদ্রিক কচ্ছপ ইত্যাদি ও আছেই।
4. খাদ্য সুরক্ষা: পরিবর্তিত জলবায়ুর কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা খাদ্য সুরক্ষার জন্য হুমকি। তাপমাত্রা এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বাড়লে অনেক ফসলের পুষ্টিগুণ কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, চাল, গম এবং অন্যান্য শস্যে প্রোটিন, আয়রন এবং জিঙ্কের পরিমাণ কমে যেতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বিভিন্ন উপায়ে:
1. তাপপ্রবাহ: উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে তাপপ্রবাহ ঘটছে, যা হিট স্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন এবং তাপঘাতের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।2003 সালে ইউরোপে এক তীব্র তাপপ্রবাহ ঘটে, যা প্রায় দুই মাস ধরে চলে। বিশেষ করে ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি এবং জার্মানিতে তাপমাত্রা অত্যন্ত বেড়ে যায়। আনুমানিক 70,000 মানুষ এই তাপপ্রবাহের ফলে মারা যায়। শুধুমাত্র ফ্রান্সেই প্রায় 15,000 মানুষের মৃত্যু ঘটে।
2. পানিবাহিত রোগ: বন্যা এবং ভারী বর্ষণের কারণে পানিবাহিত রোগ যেমন ডায়রিয়া, কলেরা, এবং ম্যালেরিয়া বাড়ছে। বন্যার পর স্যানিটেশন এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নষ্ট হলে পানিতে হেপাটাইটিস এ ভাইরাস ছড়াতে পারে।বাংলাদেশে 2017 সালের বন্যার পর হেপাটাইটিস এ এর প্রকোপ বেড়ে যায়। অনেক মানুষ নিরাপদ পানীয় জলের অভাবে আক্রান্ত হয়।
3. বায়ু দূষণ: তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়ছে, যা শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি এবং হৃদরোগের মতো শারীরিক সমস্যা বাড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ দিল্লিতে শীতকালে বায়ু দূষণ অত্যন্ত উচ্চমাত্রায় পৌঁছে, কারণ কৃষিজমির ফসলের আবর্জনা পোড়ানো, যানবাহনের ধোঁয়া, এবং শিল্প দূষণ একত্রিত হয়ে বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়ায়। এর ফলে ওজন দূষণ এবং কণিকা পদার্থ (PM2.5 এবং PM10) বৃদ্ধি পায়, যা শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি এবং হৃদরোগের কারণ হয়। এছাড়াও দাবানল নিয়মিত ঘটছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এর তীব্রতা এবং সংখ্যা বেড়ে গেছে। দাবানলের ধোঁয়া এবং কালো কার্বন বায়ুর গুণমান হ্রাস করছে, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
4. খাদ্য ও পানির অভাব: খরা এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ফলে খাদ্য এবং পানির অভাব দেখা দিচ্ছে, যা অপুষ্টি এবং পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ সাব-সাহারান আফ্রিকার অনেক দেশ, যেমন ইথিওপিয়া এবং সোমালিয়া, খরার কারণে খাদ্য সংকটে পড়ছে। খরা ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দেয়, গবাদি পশুর মৃত্যু ঘটায় এবং খাদ্য নিরাপত্তার সমস্যা সৃষ্টি করে। এছাড়াও ইরানে দীর্ঘস্থায়ী খরা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানির স্তর কমে যাচ্ছে। অনেক এলাকা সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে।
সুতরাং,পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য রক্ষায় জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবেলা করা অত্যন্ত জরুরি। এ পরিবর্তন মোকাবেলায় প্রাকৃতিক কারণগুলোর পাশাপাশি মানুষের কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, বন উজাড় এবং শিল্প উৎপাদনের ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বৃদ্ধি কমাতে হবে। সেই সাথে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, টেকসই উন্নয়ন নীতি, দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু নীতিমালা, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার এবং পরিবেশ সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান করা সম্ভব। ব্যক্তি, সমাজ এবং সরকার সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও বাসযোগ্য পৃথিবী নিশ্চিত করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই একটি নৈতিক দায়িত্ব, যা আমাদের সবাইকে পালন করতে হবে।
আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ! আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণে সাহায্য করবে। 🔗📬
লিখেছেন-
সিনহা আক্তার
কন্টেন্ট লিড
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইনোভেটিভ হেলথ রিসার্চ
Our Address
Mirpur, Dhaka-1216, Bangladesh
(Currently Online)
Our Activities
Research Internship Program
Basics of Research Methodology
Data Collection Tools
Data Analysis with SPSS