বিশ্বব্যাপী দ্রুতগামী শিল্পায়ন, প্রযুক্তির বিকাশ, এবং কর্পোরেট জগতে প্রতিযোগিতার কারণে কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের অনেক কর্মী উচ্চ মাত্রার কাজের চাপের শিকার হচ্ছেন, যা তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই পরিস্থিতি শুধু ব্যক্তিগত জীবনে নয়, বরং প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদনশীলতাকেও প্রভাবিত করছে।
বাংলাদেশে কাজের চাপের কারণসমূহ:
বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রে কাজের চাপের জন্য বেশ কিছু প্রধান কারণ চিহ্নিত করা যায়, যা কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যে সরাসরি প্রভাব ফেলে:
1. দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ও অতিরিক্ত ওভারটাইম: বাংলাদেশে অনেক কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের নিয়মিত ৮ ঘণ্টার চেয়ে বেশি কাজ করতে হয়। বিশেষ করে পোশাক খাত, ব্যাংকিং, এবং প্রযুক্তি খাতে কর্মীদের নিয়মিত ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। এই অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার ফলে শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি তৈরি হয়।
2. কাজের অস্বচ্ছতা ও নিরাপত্তার অভাব: অনেক ক্ষেত্রে কর্মীরা তাদের দায়িত্ব ও কাজের প্রকৃতি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পান না, যার ফলে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে বেসরকারি খাতের কর্মীরা চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে থাকেন। প্রাইভেট সেক্টরের দ্রুত পরিবর্তনশীল চাহিদার কারণে কর্মীদের উপর ক্রমাগত চাপ পড়তে থাকে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
3. আর্থিক অস্থিরতা ও মজুরির সমস্যা: অনেক জায়গায় দেখা যায় কর্মীরা সঠিক সময়ে বেতন পান না, যার ফলে তাদের মধ্যে আর্থিক অস্থিরতা ও চাপ তৈরি হয়। এই ধরনের অর্থনৈতিক চাপ দীর্ঘমেয়াদী মানসিক অবসাদের জন্ম দেয়।
4. প্রযুক্তিগত চাপ: প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি এবং এর সাথে তাল মিলিয়ে চলার চাপ কর্মীদের মধ্যে বাড়তি উদ্বেগ তৈরি করেছে। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর্মীরা অনবরত আপডেট হতে বাধ্য হচ্ছেন, যা মানসিক চাপের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
5. অপ্রতুল প্রশিক্ষণ: অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় ট্রেনিং বা সহায়তা প্রদান করে না। এর ফলে কর্মীরা কাজ করতে গিয়ে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন এবং মানসিক চাপে ভুগতে থাকেন।
মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব:
কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপের ফলে কর্মীদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যে বিভিন্ন ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়ে:
1. উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া: মানসিক চাপ একজন কর্মীর মনোযোগ, একাগ্রতা, এবং কাজের আগ্রহকে কমিয়ে দেয়, যার ফলে তার কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। গবেষণা অনুযায়ী, মানসিক চাপে ভুগছেন এমন কর্মীরা প্রায় ৩৫% কম উৎপাদনশীল হয়ে থাকেন।
2. মানসিক অবসাদ: ক্রমাগত মানসিক চাপ থেকে কর্মীরা ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, এবং অবসাদের মতো মানসিক সমস্যায় ভোগেন। বিশেষত যেসব কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে চাপের মধ্যে কাজ করছেন, তাদের মধ্যে ক্লান্তি এবং হতাশা বেশি পরিমাণে দেখা যায়।
3.শারীরিক সমস্যা: মানসিক চাপের প্রভাব শুধু মানসিক অবস্থার উপরেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক চাপযুক্ত কর্মীরা হৃদরোগের ঝুঁকিতে প্রায় ২০% বেশি থাকেন।
5. চাকরি পরিবর্তন: মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে অনেক কর্মী চাকরি পরিবর্তনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক চাপজনিত কারণে কর্মীদের মধ্যে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা প্রায় ২৫% বেশি।
সমাধান ও করণীয়
বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা এবং কাজের চাপ কমাতে বেশ কিছু কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু সমাধান হলো:
1. স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ: প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত কর্মীদের জন্য নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত এবং চাপমুক্ত একটি কর্মপরিবেশ তৈরি করা। বিশেষত শারীরিক আরামদায়ক পরিবেশ ও বিরতিহীন কর্মঘণ্টা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
2. মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা: মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কর্মক্ষেত্রে নিয়মিতভাবে কর্মশালা, প্রশিক্ষণ ও সেমিনার আয়োজন করা প্রয়োজন। কর্মীদের মানসিক চাপ মোকাবিলা এবং মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার কৌশল শেখানো উচিত। মনের স্কুলের মতো কিছু সংস্থা খুব অল্প খরচেই মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সভা বা ওয়ার্কশপ করে থাকে।
3.পরামর্শ ও কাউন্সেলিং সেবা: বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ সেবা বা কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা নেই। কর্মীদের মানসিক সমস্যা নিরসনে প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত পেশাদার সাইকোলজিস্টের ব্যবস্থা করা। 'কান পেতে রই' বিনামূল্যেই এধরনের সেবা দিয়ে থাকে।
4. মানসিক চাপ পরিমাপের টুলস: মানসিক চাপ পরিমাপের জন্য কিছু নির্দিষ্ট টুল বা পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন 'Perceived Stress Scale (PSS)'। প্রতিষ্ঠানের উচিত নিয়মিত কর্মীদের মানসিক চাপের মাত্রা পরিমাপ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
বিভিন্ন উন্নত দেশ কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে বেশ কিছু কার্যকর নীতি ও কৌশল গ্রহণ করেছে। যেমন, জাপান ও সিঙ্গাপুরে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা কর্মসূচি এবং ওয়ার্ক লাইফ ব্যালেন্স রক্ষায় বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশেও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন করে কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করা সম্ভব। এটি শুধু কর্মীদের স্বাস্থ্যের জন্য নয়, বরং প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনতে পারে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কাজের চাপের কারণে কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা শুধুমাত্র ব্যক্তি নয়, বরং সামগ্রিক কর্মসংস্কৃতিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। সুতরাং, মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা অত্যন্ত জরুরি।
তথ্যসূত্র
1.https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/mental-health-at-work#:~:text=The%20WHO%20guidelines%20on%20mental,participate%20and%20thrive%20in%20work.
2.https://www.ilo.org/meetings-and-events/workplace-stress-collective-challenge
3.https://bbs.gov.bd/site/page/111d09ce-718a-4ae6-8188-f7d938ada348/%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%8F%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A1-%E0%A6%87%E0%A6%AE%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A7%9F%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%9F
4.https://hbr.org/sponsored/2023/05/the-battle-against-workplace-stress
5.https://www.researchgate.net/publication/376110386_A_Systematic_Review_of_Workplace_Stress_and_Its_Impact_on_Mental_Health_and_Safety
লিখেছেন:
মো. সাদমান আল নাহিন
ক্যাম্পাস অ্যাম্বাসেডর, BIIHR
Our Address
Mirpur, Dhaka-1216, Bangladesh
(Currently Online)
Our Activities
Research Internship Program
Basics of Research Methodology
Data Collection Tools
Data Analysis with SPSS